স্বাধিনতার গল্প : মুক্তিসেনাই মৃত্যুদূত! অতপর...!
লিখেছেন লিখেছেন একপশলা বৃষ্টি ১২ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:৫২:২৮ রাত
স্বাধিনতা সংগ্রাম প্রায় শেষ। শেষ পাকহানাদারদের তাণ্ডব। এবার মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা! সন্দেহ হলেই ধরপাকড়, ক্রসফায়ার নয় ব্রাশফায়ার! পূর্ব শত্রুতা কিংবা প্রভাব বিস্তারও ইস্যু হচ্ছে নানা জায়গায়। সদ্যস্বাধীন দেশ, অবিন্যস্ত প্রশাসন -এই সুযোগে কিছু বুভুক্ষু অস্ত্রধারীর উৎপাতও যথেষ্ট ভোগাচ্ছে মানুষজনকে।
সেই সময়ের দৃশ্যপট-
'তখন অগ্রহায়ণমাস। মাঠজুড়ে সোনামোড়ানো ফসলের চাদর আর বাড়ি বাড়ি উৎসবের আমেজ।
বিস্তৃত হাওরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধান কাটছি আমরা। কোনো কোনো ক্ষেতের পাশে ছাতা মাথায় দাড়িয়ে আছেন কেউ কেউ। এমনই এক জমির পাশে দাড়িয়ে আছেন এক তরুন আলেম। হঠাৎ আমাদের পাশ দিয়ে দু'জন লোক দৌড়ে চলে গেল। ভালো করে খেয়ালই করেনি সবাই। একটু পর পিছু ধাওয়া করে ছুটে এল এক ছিপছিপে তরুন। হাতে খাড়া করেরে ধরে আছে মেশিনগান। মুক্তিযোদ্ধা সে। এসেই অর্ডার, 'সবাই কাতার সোজা করে দাড়াও!'
একথার অর্থ জানি আমরা। নে এবার রেহাই নেই। ভয়ে কাঁপছে সবাই। সবাই সারি বেঁধে দাড়াচ্ছি। ছেলেটির সামনে দাড়িয়ে আছেন ঐ তরুন আলেম। আর লাইনে না দাড়িয়ে সময় ক্ষেপন করতে হাতের ইশারা করছেন আমাদের। উপায় নেই! আমরা একে একে এগুচ্ছি আর তিনি কথা বলে যাচ্ছেন ছেলেটির সাথে। চাইছেন মেজাজটা ঠাণ্ডা করতে।
জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হয়েছে ভাই?'
'এ লোকগুলো রাজাকার। আমার পুরো পরিবারকে হত্যা করে এসেছে। তোমাদের সামন দিয়ে গেছে ওরা।'
ছেলেটি কথা বলতে পারছে না। রাগে টগবগ করছে।
তিনি শান্ত কন্ঠ। তীক্ষ্ণ চাহনী, তবে স্থীর।
'তাহলে এরা জজমা হবে কেন! এদের দোষ কী?'
ছেলেটি এক জায়গায় স্থীর হচ্ছে না। যেন ছটফট করছে। ট্রিগার ধরে আছে এক হাতে। 'এদের আটকালে না কেন?
এতকিছু বুঝি না। দাড়াও, দাড়াও। একটাও রাখব না।'
হাওরের মাঝ দিয়ে ছোট্ট এক খাল বয়ে গেছে। ওপাশেও কাজ করছে কিছু লোক। তিনি আরেকটু সময় নাতে চাইলেন। ওদিকে ইশারা করে, 'তাহলে তো ওপাড়ের লোকেরাও সমান দায়ী? ওরাও তো ধাওয়া করেনি!'
এবার ওপাড়েও ডাক পড়ল। ওরাও আসতে লাগল। এই ফাঁকে তিনি কথা বলে যাচ্ছেন।
'আচ্ছা স্যার! ওরা পালাল কোনদিকে?'
'গ্রামের দিকে।'
'তাহলে আর যাবে কোথায়! চলুন যেকরেই হোক ওদের বের ককরব। আমি আপনার সাথে আছি।'
সেও রাজি হয়ে যায়। আমরা নিশ্চত মৃত্যু থেকে রেহাই পাই।
গল্পটা বলছিলেন, আমাদের গ্রমের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব খলিল মিয়া সাহেব। আমরা তখন আসরের নামাজ শেষে মসজিদের ঘাটে বসে শুনছি।
ইত্যোবসরে, তিনি ইশারা করে বললেন, 'এই তো এসে গেছেন।' আমরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখি চিরচেনা এক হাসিমাখা মুখ। সবাই একসাথে সালাম দিয়ে উঠি। এসে গেছেন সেই সম্মানিত আলেম -যিনি নিজেকে বন্দুকের মুখে রেখে শতশত মানুষের জীবন রক্ষার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। খলিল সাহেবের কথার রেশ ধরে তিনি বাকি গল্প শেষ করেন।
'ছেলেটি এতটাই রোগা ছিল, একহাতে ধরলেও যেতে পারত না। কিন্তু সে মুক্তিসেনা! একটা কিছু হলে পরে মুক্তিরা এসে সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। মনে মনে ভাবছিলাম যদি গুলিই করে বসে তবে বন্দুকের নল উপরের দিকে তুলে দেব। এরপর যা হবার হবে। তবে আগে কোনো পদক্ষেপ নেব না। পরে ছেলেটিকে গ্রামের ভেতর দিয়ে এক মুক্তি-অফিসারের বাড়ি নিয়ে যাই। তিনি ছেলেটিকে শান্ত করে খাবার দাবারের পর বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
বেশ কিছুদিন পর মৌলভীবাজার শহরে ছেলেটির সাথে দেখা হয়। সে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, 'ভাই সেদিন আপনি না হলে এতগুলো মানুষ মারা পড়ত।'
মজার ব্যপার হল, ওপারে যখন ডাকতে বলি, সেখানে আমার চাচা শ্বশুর তাঁর ছেলেদের নিয়ে ধান কাটছিলেন। যখন মিলিটারি ডাক দিল, তিনি ছেলেদের পাঠিয়ে নিজে আইলের পিছে শুয়ে শুয়ে পালিয়ে যান। সেদিনের কথা মনে হলে আজও হাসি পায়।'
গল্পটা শেষ হলে উপস্থিত সবাই হেসে উঠি।
আমি ভাবি, হায় মুক্তিযুদ্ধ! কতভাবে তুমি মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছ!
(আজ কয়েকশ মানুষের জীবন বাঁচাতে বন্দুকের নলের সামনে দাড়ানো সেই আলেম পরপারের বাসিন্দা। আল্লাহ তাঁর মর্যাদা সমুন্নত করুন। আমিন।)
বিষয়: বিবিধ
১০৭৫ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন